বিজ্ঞান প্রবন্ধ:- কোয়ার্ক
আমরা চারপাশে কত বস্তুই না দেখছি। তারা কেউ কঠিন (Solid), কেউ তরল (Liquid) কেউবা আবার গ্যাস (Gas)। বলতে পারা যায় যে ‘কত রঙিন এ দুনিয়া কি বিচিত্রময়’। কিন্তু যতই রঙিন বা বিচিত্রময় এই দুনিয়া হোক না কেন, সবাই বলতে গেলে একই ধাতুতে গড়া। এর মানে এই যে প্রতি বস্তুই পরমাণু (atom) দ্বারা গঠিত। প্রাচীনকালের কণাদ মুনি থেকে শুরু করে ১৯ শতকের ইংরেজ বিজ্ঞানী জন ডাল্টন সবাই বলে গেছেন যে প্রতি বস্তুকেই খণ্ড-খণ্ড করতে করতে এমন এক পরিস্থিতিতে গিয়ে ঠেকবে যে তখন আর তাকে ভাঙা যাবে না- বস্তুর সেই চূড়ান্ত রুপটিকে বলা হয় পরমাণু। আসলে ইংরেজি ‘atom’ কথাটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘atomos’ থেকে যার অর্থ ‘indivisible’ (অবিভাজ্য) বা ‘impossible to cut’।মোট কথা পরমাণু হল বস্তুর এমন এক চূড়ান্ত পর্যায় যাকে আর ভাঙা যায় না।
কিন্তু বিজ্ঞান যে থেমে থাকে না। সময়ের সঙ্গে সেও পাল্লা দিয়ে সামনের দিকে ছোটে।আর এই ছোটার ফলেই পরমাণু তার ‘অবিভাজ্য’ নামক যে আভিজাত্য দম্ভ ছিল তাও গেল হারিয়ে। উনবিংশ শতাব্দির শেষাংশ এবং বিংশ শতাব্দির প্রথমাংশে আবিষ্কৃত হয় পরমাণুর অন্দরে তিনটি কণা। যথা:- ইলেকট্রন (জে জে থমসন দ্বারা ১৮৯৭ সালে আবিষ্কৃত), প্রোটন (আর্নেস্ট রাদারফোর্ড দ্বারা ১৯১৯ সালে আবিষ্কৃত) এবং নিউট্রন (জেমস চ্যাডউইক দ্বারা ১৯৩২ সালে আবিষ্কৃত)।
অতএব দেখা গেল যে পরমাণুও ‘ভাজ্য’ (divisible)। কিন্তু ওই যে আগেই বললাম বিজ্ঞান থেমে থাকে না। আর তাই এই তিনটি কণা-কে যে Fundamental Particle (মৌলিক কণা) বলা হত, তা আর বলা গেল না। কণা ত্বরক (Particle accelerator) আবিষ্কার হওয়ার পর দেখা গেছে যে প্রোটন ও নিউট্রন আর মৌলিক কণা নেই। তারা এক ধরনের ক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি যার নাম কোয়ার্ক (Quark)। তখন ইলেকট্রনকে মৌলিক কণা ধরলেও অতি সম্প্রতি দেখা গেছে যে ইলেকট্রনকেও বিভাজন করা যায়। ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তাত্ত্বিকভাবে এই কণার বিষয় উপস্থাপন করেন মারে গেল-মান (Murray Gell-Mann) এবং জর্জ জিউইগ (George Zweig)। ১৯৬৮ সালে এটি পরীক্ষায় পাওয়া যায়। কোয়ার্করা একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে গ্লুওন (Gluon) দ্বারা। মানে বলতে গেলে গ্লুওন গ্লু-এর মতো কোয়ার্কগুলোকে জুড়ে রাখে।
নানা ধরনের কোয়ার্কের খোঁজ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিজ্ঞানীরা এদের বলেন ভিন্ন স্বাদের (flavours)-এর কোয়ার্ক। না, এ স্বাদ কিন্তু খাবারের নয় বরং জাতের বা রকমের। এবার সে কথায় আসি। কোয়ার্ক মোট ৬ রকম স্বাদের। যথা:- আপ, ডাউন, চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ এবং বটম। পৃথিবীর সব বস্তুই আপ এবং ডাউন কোয়ার্কে তৈরি। আপ, চার্ম এবং টপ কোয়ার্কের চার্জ হল +২/৩ ইলেকট্রন চার্জ। অপরদিকে ডাউন, স্ট্রেঞ্জ ও বটম কোয়ার্কের চার্জ হল -১/৩। মজার কথা হল প্রত্যেক কোয়ার্কেরই আবার অ্যান্টি কোয়ার্ক আছে- যারা কোয়ার্কগুলোর মতোই দেখতে কেবল চার্জ যা উল্টো। যেমন আপ, চার্ম এবং টপ অ্যান্টি কোয়ার্কের চার্জ হল -২/৩ ইলেকট্রন চার্জ। অপরদিকে ডাউন, স্ট্রেঞ্জ ও বটম অ্যান্টি কোয়ার্কের চার্জ হল +১/৩।
আরেকটা ব্যাপার (যদিও সেটা কাল্পনিক) তা হল এই যে প্রতি স্বাদের কোয়ার্ক আবার তিন রঙের হয়- লাল, সবুজ, নীল। যেমন আপ কোয়ার্কের ক্ষেত্রে ধরা যাক লাল আপ কোয়ার্ক, সবুজ আপ কোয়ার্ক, নীল আপ কোয়ার্ক। আবার অ্যান্টি কোয়ার্কদের রঙগুলোকে বলে অয়ান্টিরেড, অ্যান্টি ব্লু, অ্যান্টি গ্রিন। মনে হয় এ যেন ‘লাল, নীল, সবুজের মেলা বসেছে’ আর তা দেখতে দেখা যাবে যে মোট ১৮টি (৬স্বাদের* ৩ রকমের রঙের) কোয়ার্ক আছে এবং এর সাথে ওদেরই মতো ১৮টি অ্যান্টি কোয়ার্ক আছে। তাহলে দাঁড়াল মোট কোয়ার্কের সংখ্যা ১৮+১৮=৩৬।
একটু আগেই বললাম যে বেশীরভাগ বস্তুই আপ এবং ডাউন কোয়ার্কে তৈরি। দুটো আপ কোয়ার্ক আর একটা ডাউন কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি প্রোটন (২/৩+২/৩-১/৩=+১ চার্জ) আবার দুটো ডাউন কোয়ার্ক এবং একটা আপ কোয়ার্ক দিয়ে তৈরি নিউট্রন (২/৩-১/৩-১/৩=০ চার্জ)। তাই প্রোটন ধ্বণাত্মক এবং নিউট্রন চার্জহীন। বাকি চার স্বাদের কোয়ার্ক কণা ত্বরকে তৈরি করা যায়। তাদের কাউকে আবার তারাদের অন্তরে পাওয়া গেলেও যেতে পারে। দুটো বা তার একাধিক কোয়ার্ককে শক্তিশালী নিউক্লিয়ার বল (strong nuclear force) দ্বারা জুড়ে তৈরি হয় হ্যাড্রন (Hadron)।
দুই রকমভাবে উপায়ে কোয়ার্করা মিলিত হয়ে দুই রকমের হ্যাড্রন তৈরি করে। সেই হিসেবে হ্যাড্রনকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে:-
তাহলে বোঝাই যাচ্ছে যে অতি-পারমাণবিক কণা মৌলিক কণা কোয়ার্ক কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
---------------------------*--------------------------------