Adib Akhand

১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১২:০০


বিভাগ: ইতিহাস

পড়ার সময়: ৩ মিনিট


প্রাচীন বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ ও আলেকজান্দ্রীয় গ্রন্থাগার


আমরা স্কুলে যেই অ্যাপোলোনিয়াসের উপপাদ্য পড়েছি, সেই উপপাদ্যের জনক অ্যাপোলোনিয়াসও (Apolonious) কিন্তু এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। তিনি অধিবৃত্ত, পরাবৃত্ত, উপবৃত্তের ধারণা দিয়েছিলেন এই গ্রন্থাগারেই। এছাড়াও, এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন এরাটোস্থেনিয়াস (Eratosthenes) যিনি প্রথমবার পৃথিবীর পরিধির মাপ আবিষ্কার করেছিলেন।

কে বা কারা বিজ্ঞানের শুরুটা করেছিলো তা এখনো অজানা। তবে প্রাচীন ভাষ্যমতে বিজ্ঞান ও গণিতের জনক হচ্ছে থেলিস (Theles)। এর পরেই আসে পিথাগোরাস (Pythagoras), সক্রেটিস (Socrates), প্লেটো (Plato) ও অ্যারিস্টটল (Aristotle) -দের মতো বিজ্ঞান,গণিত-বিদদের নাম। তবে প্রাচীন বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ তখনও শুরু হয়নি।

এই স্বর্ণযুগটার প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন শিক্ষক অ্যারিস্টটলের ছাত্র গ্রিকবীর আলেকজান্ডার, আলেকজান্ডার দি গ্রেট (Alexander)। ৩৩২ খ্রিষ্টাব্দে রক্তপাতহীন দখলের মাধ্যমে মিশর প্রবেশ করেন আলেকজান্ডার। মিশরে তখন দুর্ভিক্ষ চলছিলো দেখে মিশরবাসী সানন্দেই আলেকজান্ডারকে গ্রহণ করে। সেখানে মিশরের ঐশ্বর্যে মুগ্ধ হয়ে ভূমধ্য সাগরের উপকূলে একটি শহর তৈরি করেন আলেকজান্ডার, যে শহরের নাম হয় 'আলেকজান্দ্রিয়া'। যা রাজধানী হিসেবে প্রায় ৩০০বছর সারা বিশ্ব শাসন করে। সেখানেই আলেকজান্ডারের সেনাপতি দ্বিতীয় টলেমি (Ptolemy II) তৈরি করেন আলেকজান্দ্রিয়ার বিষ্ময় -বিশ্বের প্রথম নিয়মতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধশীল 'আলেকজান্দ্রিয় গ্রন্থাগার'।

এখানে সুশৃণ্খলভাবে পুঁজি করে রাখা হত জ্ঞান। রাজবংশের কর্মচারীরা বিভিন্ন দেশ থেকে বই, পাণ্ডুলিপি ধার করে এনে রাখতেন এই গ্রন্থাগারে। দেশ-বিদেশ থেকে অধ্যায়ন করতে আসতেন বিভিন্ন জাতির, বিভিন্ন ধর্মের ব্যক্তিরা। এই গ্রন্থাগারে আজকের মত বই ছিলো না, সেখানে লেখা থাকতো প্যাপিরাসের (Papyras) পাতায়, প্যাপিরাসের স্ক্রলে। ঠিক কতগুলো প্যাপিরাসের স্ক্রল ছিলো সেই গ্রন্থাগারে তা জানা যায়নি। তবে অনুমান করা হয় প্রায় ১০ লক্ষাধিক প্যাপিরাসের স্ক্রল ছিলো এই গ্রন্থাগারে। এটি ছিলো তখনকার সারা বিশ্বের বুদ্ধি বৃত্তির চেতনা। এই গ্রন্থাগারের একটি বইয়ের লেখক ছিলেন আয়োনিয়ার সামোস দ্বীপের অ্যারিস্টকার্স (Aristaurchus), যিনি সর্বপ্রথম সূর্যকে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে স্থান দেন। কিন্ত প্লেটো, অ্যারিস্টটল-দের মতবাদ এর বিরুদ্ধে ছিলো দেখে তখন কেউ তার মতবাদ বিশ্বাস করেনি।

এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন এরাটোস্থেনিয়াস (Eratosthenes), যাকে সব বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বলা হয়। তিনিই আলেকজান্দ্রিয় শহর থেকে সায়িন নামক স্থানের দূরত্ব মাপতে গিয়ে প্রথমবার পৃথিবীর পরিধির মাপ আবিষ্কার করেছিলেন, আবিষ্কারের কাহিনীটা না হয় রহস্যই থাকুক (যদি জানতে ইচ্ছে হয় তাহলে উইকিপিডিয়া ঘাটলেই পেয়ে যাবেন)।

এরাটোস্থেনিয়াসকে ভূগোলের জনকও বলা হয়। আমরা স্কুলে যেই অ্যাপোলোনিয়াসের উপপাদ্য পড়েছি, সেই উপপাদ্যের জনক এ্যাপোলোনিয়াসও (Apolonious) কিন্তু এই গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক ছিলেন। তিনি অধিবৃত্ত, পরাবৃত্ত, উপবৃত্তের ধারণা দিয়েছিলেন এই গ্রন্থাগারেই। এমনকি টলেমির বিশ্বমডেল যেই ডিফারেন্ট ও এপিসাইকেলের উপর নির্ভর করে তৈরি হয়েছিল সেই ডিফারেন্ট ও এপিসাইকেলের প্রবক্তাও তিনি।

পৃথিবীর প্রথম রোবটের উপর গ্রন্থ 'Automato' নামক গ্রন্থটি তো এই গ্রন্থাগারেই লিখছিলেন হেরন।শুধু রোবটের উপর গ্রন্থনয় গিয়ার ট্রেন ও স্টিম ইঞ্জিনের উদ্ভাবকও এই হেরণ। জ্যামিতির জনক ইউক্লিড (Euclid) তো এই গ্রন্থাগারেই বিধিবদ্ধ করেছেন জ্যামিতিকে;তাছারা ইউক্লিডের সেই ইলিমেন্টস গুলো, যা বদলে দিয়েছে আমাদের ভাবমূর্তি।

ক্লাসিক্যাল যুগের শ্রেষ্ঠ পদার্থবিদ আর্কিমিডিসের (Archimedes) কথাই বা বাদ যাবে কেনো; যিনি পদার্থবিদ্যায় স্থিতিবিদ্যার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ও নলকূপ থেকে পানি তোলার জন্য স্ক্র পাম্প আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিই প্রথমবার গাণিতিকভাবে বিশ্লেষণ করে পাই'য়ের মান বের করেছিলেন। এই আর্কিমিডিসই কিন্তু লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির আগ পর্যন্ত যন্ত্র কৌশলে শ্রেষ্ঠ প্রতিভা। আর 'ইউরেকা' বলে গোসলখানা থেকে রাজঘরে যাওয়ার ঘটনা না হয় নাইই বলি। আলেকজান্দ্রিয়ার শরীরবৃত্তবিদ সেই হিরোফিলাস (Herophilus), যিনি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন যে- মন নয়,মস্তিষ্কই হল সকল বুদ্ধিমত্তার কেন্দ্র। আলেকজান্দ্রিয় গ্রন্থাগার শুধু গ্রন্থাগারই ছিলো না, এটি ছিলো সারা বিশ্বের প্রথম বৈজ্ঞানিক ও গাণিতিক গবেষণাগার।

আর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্যোতিষ্ক পর্যবেক্ষক হিপ্লাকার্স (Hipparchus) তো এই গ্রন্থাগারেরই সদস্য ছিলেন।যিনি নক্ষত্রলোকের মানচিত্র অংকন করেন এবং নক্ষত্ররাজির উজ্জ্বলতারও পরিমাপ করেন।

এমনি তিনিই সর্বপ্রথম নির্ভরযোগ্য সূর্যগ্রহণের ভবিষ্যৎবাণী করেন। তারপর!!!!!!! তারপর তো রোমান রাজা জুলিয়াস সিজার মিশর দখলের সময় আলেকজান্দ্রিয়াসহ আলেকজান্দ্রিয়ার বিষ্ময় সেই গ্রন্থাগারটিও আগুনে পুড়িয়ে দেয়।

শিল্পীর চোখে জ্বলছে লাইব্রেরি।
Caption

যা ছিল আমাদের জন্য দূর্যোগপ্রবণ যুদ্ধ। সেখান থেকে অবশ্য কিছু প্যাপিরাসের স্ক্রল ছাই হওয়া থেকে রেহাই পেয়েছিল। সেই প্যাপিরাসের স্ক্রল দিয়ে পরে আবার আরেকটি ছোট-খাটো গ্রন্থাগার গড়ে তোলা হয়েছিলো। যার একটি বিশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে জ্যোতির্বিদ ও আজকের দিনের জ্যোতিষ -শাস্ত্রের এক অপবৈজ্ঞানিক টলেমি (Ptolemy)। যার জন্ম যিশু খ্রিষ্টের মৃত্যুর ৯০ বছর পর। এই টলেমির সাথে কিন্তু রাজবংশের টলেমির সাথে কোনো সম্পর্ক নেই। এই টলেমির একটি বই আছে যা জ্যোতির্বিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাবশালী বই, বইটির নাম হচ্ছে আলমাজেস্ট। কিন্তু এই বইয়ে অ্যারিস্টকার্সের বদলে অ্যারিস্টটলের মতবাদ প্রাধান্য পায়,যা আমাদের ১৫০০ বছর জ্যোতির্বিজ্ঞানে পিছিয়ে দিয়েছে।'

মহাবিশ্বের কেন্দ্রে পৃথিবী, যাকে সুর্যসহ অন্যান্য জ্যোতিষ্কও কেন্দ্র করে ঘোরে'- এই কথাটিকে টলেমি একেবারে ধ্রুব সত্যে পরিণিত করে ফেলেন। এমনকি আকাশের জ্যোতিষ্কপুঞ্জ আমাদের জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করে - এই কথাটিকেও টলেমি ধ্রুব সত্যে পরিণত করে ফেলেন। সাথে সাথে চার্চ শাষিত অঞ্চলে প্লেটো,অ্যারিস্টটল ও টলেমি তিন পথ প্রদর্শকে পরিণত হয়। ক্যাথলিক চার্চ তাদের কে কঠোর শাস্তি দিতো যারা টলেমির মতবাদের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করত।

তখন ইউরোপ অন্ধকার যুগে প্রবেশের একেবারে দ্বারপ্রান্তে। বেশিরভাগের মতে হাইপেশিয়ার (Hypatia) মৃত্যু পরপরই ইউরোপের অন্ধযুগ আসে।এই হাইপেশিয়া পৃথিবীর প্রথম নারী জ্যোতির্বিদ।এই হাইপেশিয়া গিয়ার ট্রেন ও স্টিম ইঞ্জিনের উদ্ভাবক হেরণের কণ্যা। হাইপেশিয়া জ্যোতির্বিদ্যায় মৌলিক কোন ভূমিকা না রাখলেও পূর্বের অনেক কিছু তিনি চর্চা করতেন এবং সূক্ষভাবে তারা তালিকা প্রণয়ন করেন। আলেকজান্দ্রিয়া গ্রন্থাগারের যা কিছু অবশিষ্ট ছিলো তা দিয়েই তিনি চর্চা করতেন এবং শিক্ষা দিতেন। হাইপেশিয়া ছিলেন প্লেটোবাদী ও সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী। কিন্তু এই শহরে আস্তে আস্তে খ্রিষ্টান ধর্মের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। তখন আলেকজান্দ্রিয়ার বিষপের নির্দেশে একদল খ্রিষ্টান জঙ্গি বাহিনী ৪৪২ খ্রিষ্টাব্দে হাইপেশিয়াকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবেই শেষ হয়ে যায় সেই স্বর্ণযুগ ও স্বর্ণযুগের বিষ্ময়। যা যদি বেঁচে থাকলে আজ আমরা আরো উন্নত, আরো আধুনিক হোতাম। অনেক বছর পর ঐরকম ক্লাসিক্যাল না হলেও আরেকটি উজ্জ্বল যুগ ফিরিয়ে আনেন কোপার্নিকাস (Copurnicus),গ্যালিলিও (Galilio),কেপলার (Kepler),নিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চি(Leonardo de Vinchi), টাইকো ব্রাহে (Tycho Brahe) 'র মত বিজ্ঞানীরা। কিন্তু আফসোস সেটাই,যেটা আমরা আর ফিরে পাবোনা আর তা হল সেই স্বর্ণযুগ,আলেকজান্দ্রিয় যুগ।

লাইব্রেরির বর্তমান রূপ।
Caption

তথ্যসূত্র--

  1. www.banglainternet.com/pdfscience/special/cosmos_by_carl_sagan_p1.pdf
  2. www.banglainternet.com/pdfscience/special/cosmos_by_carl_sagan_p2.pdf
  3. en.m.wikipedia.org/wiki/Library_of_Alexandria
  4. bn.m.wikipedia.org/wiki/হাইপেশিয়া
  5. bn.m.wikipedia.org/wiki/আর্কিমিডিস
  6. en.m.wikipedia.org/wiki/Euclid