মীর তাফহীম মাহমুদ

১৪ জানুয়ারি ২০১৫ ১২:০০


বিভাগ: সাইকোলজি

পড়ার সময়: ৩ মিনিট


ভয় কী? আমরা ভয় কেন পাই? ভয় পেলে কী হয়?


আমাদের ভয়ের প্রধান কারণ হলো মস্তিষ্কের এমিগডালা। এর থেকে নিঃসৃত হরমোন এবং বিপদ সংকেতগুলোই আমাদের ভয়ের কারণ। মজার ব্যাপার হলো, ভয়ের সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারটা বুঝতে পারলে আপনি ধরতে পারবেন কেউ মিথ্যা বলছে কি না...

ভয় কথাটা শুনলে আমাদের ভয় লেগে উঠে। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হলো আমরা এই ভয় নিয়ে সামান্য কিছুও ভাবি না। আমরা কি জানি, ভয় জিনিসটা কী? আমরা ভয় পাই কেন? আমরা ভয় পেলে কয়েক পা পিছিয়ে যাই কেন?

যাই হোক, ভয় নিয়ে আমি নিজেই কিছু চিন্তা করে ফেলেছি।

ভয় কী?

প্রথমে ভয় কী তা জেনে নেয়া জ্যাক

ভয় আসলে এক ধরনের অনুভূতি। সাধারণ অনুভূতি নয়, বিশেষ এক অনুভূতি। এই ভয়ের অনুভুতি আমাদের তখনই হয় যখন আমরা ভীতিমূলক কোনো কিছু দেখি বা শুনি অথবা চিন্তা করি। এই অনুভূতি আমাদের অনেক ক্ষতি করতে পারে। অনেক সময় এই অনুভূতি আমাদের মস্তিষ্কের বিপুল পরিমাণ ক্ষতি করে দিতে পারে এমনকি মানুষ এর ফলে মারাও যেতে পারে।

কেন ভয় পাই?

আমরা যখন ভীতিমূলক জিনিস দেখি, শুনি বা চিন্তা করি তখন আমাদের মস্তিষ্কের ‘এমিগডালা’ (মস্তিষ্কের একটি অংশ) কাজ করতে শুরু করে। এই এমিগডালা এক ধরনের হরমোনের জোয়ার ভাসিয়ে দেয়। এই হরমোনের জোয়ার আমাদের ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ মুছে দেয়।

এছাড়াও এই এমিগডালা থেকে এক ধরনের বিপদ সংকেত শরীরের সব অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এসব কারণে আমরা ভয় পাই।

আমরা ভয় পেলে কয়েক পা পিছিয়ে পড়ি বা মাঝেমাঝে মরে যাই কেন?

আমরা অনেক সময় দেখি আমরা ভয় পেলে কয়েক পা পিছিয়ে পড়ি। এর কারণ, আমরা যখন ভয় পাই তখন আমাদের মস্তিষ্কের ‘এমিগডালা’ যখন পুরো শরীরকে বিপদ সংকেত পাঠাতে শুরু করে তখন আমাদের ‘চোখ’ এই বিপদ সংকেত দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়। এমিগডালার বিপদ সংকেত পেলে আমাদের চোখ বড় হয়ে গিয়ে যত দ্রুত সম্ভব চারপাশের পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকে এবং তা আমাদের মস্তিষ্ককে জানাতে থাকে। মস্তিষ্ক চোখের এই তথ্য পাওয়ার পর আমাদের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে দেয় আর তখন আমাদের হৃদপিণ্ডের রক্ত চলাচল বেড়ে যায় সাধারণ ভাষায় আমরা যাকে বলি হাই ব্লাড প্রেসার (High blood pressure) বা উচ্চ রক্তচাপ (Hypertension-হাইপারটেনশন) । রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়ার কারণে সেটা অভিকর্ষের ফলে আমাদের সর্বাঙ্গে সমানভাবে না ছড়িয়ে নিচের দিকে তথা পায়ের দিকে বেশি ছড়িয়ে পড়ে।

উচ্চ রক্তচাপ হঠাৎ সৃষ্টি হওয়ার কারণে আমাদের রক্তপরবাহী নালী সামঞ্জস্যতা হারিয়ে ফেলে। তাই উচ্চরক্তচাপের ফলে পায়ের দিকেই বেশি রক্ত যায়। 

অর্থাৎ, আমরা ভয় পেলে আমাদের পায়ের দিকে উচ্চ রক্তচাপ থাকে বলে আমাদের পা তার যায়গা থেকে সরে যায়। তাই আমরা ভয় পেলে না চাইলেও সরে যাই।

হাইপারটেনশন (Hypertension) বা উচ্চ রক্তচাপ মাঝে মাঝে আমাদের মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। এই উচ্চ রক্তসঞ্চালনের ফলে যখন রক্ত সঞ্চালনের ব্যাঘাত বেশি ঘটে আমাদের মস্তিষ্কের সহ্যক্ষমতার বেশি হয়ে যায় তখন আমাদের ব্রেইন স্ট্রোক হতে পারে। তাই মানুষ ভয় পেলে মাঝেমাঝে মারা যায়। 

আমাদের মস্তিষ্ক পুরো শরীরের রক্তের মাত্র ২% রক্ত ব্যবহার করে। তাছাড়া, আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলো অনেক সংবেদনশীল। আমাদের উচ্চরক্তচাপের ফলে রক্ত মস্তিষ্ক অপেক্ষা পায়ের দিকে বেশি সঞ্চালিত হয়। এর ফলে মস্তিষ্কে তার প্রয়োজন অপেক্ষা কম রক্ত সঞ্চালিত হয় তাই মানুষের উচ্চ রক্তচাপের ফলে মৃত্যু ঘটতে পারে।

এই অবস্থায় যদি ভীত ব্যক্তিকে কোনোভাবে শোয়ানোর ব্যবস্থা করানো যায় তবে রক্ত মস্তিষ্কে মোটামুটি ঠিকঠাকভাবে সঞ্চালিত হতে পারবে।

উপরের কারণগুলোর জন্যই আমাদের ভয়ানুভূতি জন্ম হয়।

ভীত ব্যক্তিকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শোয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যক্তি যদি বৃদ্ধ হয় তবে যে জায়গায় ভয় পাবে সেখানেই শোয়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলে ভীত ব্যক্তিকে বাঁচানো সম্ভব হবে। 

ভয় পেলে আমাদের মুখ সাদা যায় কেন?

উপরের লেখা গুলো পড়লে বুঝা যাবে যে, আমাদের যখন উচ্চা রক্তচাপ হয় (Hypertension) হয় তখন আমাদের হৃদপিণ্ডের রক্তগুলো উপর অপেক্ষা নিচের দিকে বেশি সঞ্চালিত হয়। এই রক্ত উপরে সঞ্চালিত কম হয় বলে আমাদের মুখ রক্তের অভাবে সাদা হয়ে যায়। তাই আমরা বলি ভয় পেলে মানুষের মুখ সাদা হয়ে যায়। 

ভীত মানুষ চলতে এবং কিছু বলতে পারে না কেন?

ভীত মানুষ চলতে পারে না। কারণ ভীতিমূলক জিনিস দেখলে মস্তিষ্কের ‘এমিগডালা’ নামের অংশটি আমাদের ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ গুলো মুছে দেয়। আর এই ‘শর্ট টাইম মেমোরি’-র কাজই হলো প্রবর্তীতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে তা পুরো শরীরকে জানানো। এক্ষেত্রে ‘শর্ট টাইম মেমরি’ মুছে যাওয়ার ফলে ভীত মানুষ পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পারেনা। তাই ভীত মানুষ চলতে পারে না এবং কিছু বলতে পারে না।

মানুষের ভয় আমরা আরেকটা সময় শনাক্ত করতে পারি। সেটা হলো মিথ্যা কথা।

মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে সে যত সাহসী লোকই হোক না কেন সে ভয় পাবে। সে যদিও মনে করে সে কোনো ভয় পাচ্ছে না কিন্তু তার মস্তিষ্ক ভয় পায়। মস্তিষ্কের ভয় পাওয়া একজন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। মানুষ যখন মিথ্যা কথা বলে তখন সেই ‘এমিগডালা’ হরমোনের জোয়ার ভাসিয়ে ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ নষ্ট করে দেয়। তাই যখন একজন মানুষ মিথ্যা কথা বলে তখন তার মধ্যে এক ধরনের অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায়।

কেউ মিথ্যা কথা বললে তার হাতগুলো অবশ্যই প্রয়োজন অপেক্ষা বেশি নড়চড় করে।

হাত প্রয়োজন অপেক্ষা বেশি নড়চড়ের কারণ আমাদের ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ মুছে যাওয়ার ফলে আমাদের মস্তিষ্ক বুঝতে পারে না কোন কথা বলার জন্য কতটুকু জোর দেয়া লাগবে।

পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে সত্য কথা বলার সময় একটি বাক্যের প্রতি ১৩-১৪ টা শব্দের পর একবার হাত নড়ে। কারণ, হাত নেড়ে কথার উপর একটা জোর দিতে হয়।

কিন্তু, মিথ্যা কথা বলার সময় একজন মানুষের প্রতি ২-৩ টা শব্দ উচ্চারণের পর মিথ্যাবাদীর একবার হাত নড়ে। কারণ, তার ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ মুছে যাওয়ায় বুঝতে পারে না কোন কথাগুলোর জন্য জোর প্রয়োগ করার দরকার হয়।

এই হাত নড়চড় পর্যবেক্ষণ করে আমরা সহজে একটা মিথ্যাবাদীকে শনাক্ত করতে পারি।

(এখানে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে একজন মানুষকে বর্ণনামূলক মিথ্যা এবং বর্ণনামূলক সত্য কথা বলিয়ে) 

কিন্তু, অনেক সময় অনেকে সত্য কথা বলার সময়ও ভয় পায়। অর্থাৎ তার কথা স্পষ্ট হয় না। কিন্তু সত্য কথা বলার সময় ভয় পেলেও তার ‘শর্ট টাইম মেমোরি’ গুলো মুছে যায় না। তাই সত্য কথা বলার সময় হাত কম নড়ে। এভাবে মানুষের মস্তিষ্কের ভয় দিয়ে সত্য ও মিথ্যা শনাক্ত করা যায়।