সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯ হাজার ফুট উঁচুতে এক রহস্যময় হ্রদের অবস্থান। যার ভেতর লুকিয়ে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। তবে ঠিক কত টাকার সম্পদ রয়েছে, তার হিসেব কেউ জানে না। এই হ্রদে এত বিপুল পরিমাণে অর্থ থাকলেও, তার নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থাই সেখানে নেই। প্রতি বছর এই রহস্যময়ী হ্রদে দলে দলে লোকেরা নিজের মনোবাসনা নিয়ে আসেন। বর্তমানে সেই সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। হ্রদের গুপ্তধন বেশ কয়েকবার চুরির চেষ্টা করেও, চোরেরা সফল হয়নি। কোনো না কোনো ভাবে বাধা পেয়েছে তারা...! এই রূপকথার হ্রদের অবস্থান কোথায় আমার জানা নেই, সবই কল্পনাবিলাস মাত্র।
গ্রামের বড় বড় পুকুরে বা ছোট নদীতে এক সময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। পুকুরে বা নদীতে গজার মাছের আধিক্য থাকলে মুরুব্বিদের মুখে বলতে শুনেছি এই মাছ বড় হয়ে সিন্দুকে পরিণত হয় বা কোথাও কোথাও বিশালাকৃতির তামার পাতিলে পরিণত হয়, যাতে গুপ্ত ধন হিসেবে প্রচুর সোনা দানা ও কাচা টাকায় ভর্তি থাকে। কিন্তু কাচা টাকার রহস্য আজো আমার অজানাই রয়ে গেছে, জানা হলো না এই টাকা দেখতে কেমন! ছোট বেলায় সন্ধ্যা বা ভর দুপুরে পুকুরের পাশে যাওয়া আমাদের সম্পুর্ন বারণ ছিলো। কারণ হলো কথিত তামার পাতিল বা সিন্দুক বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যায়। কাউকে আগে স্বপ্নে দেখিয়ে নাকি এইসব পাতিল ও সিন্দুক বাচ্চাদের ধরে নিয়ে যেতো। তাই তখনকার সময়ে মুরুব্বিদের ভয় ছিল পুকুর ও নদীতে বসবাস রত তথাকথিত পাতিল ও সিন্দুক নিয়ে। এই রূপকথার আদৌ কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই একথা এখন আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। আপনারাও আমার সঙ্গে নিশ্চয়ই একমত হবেন।
আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যাঁরা যমজ ফল খান না, এমনকি ফল কেনার সময় ভুলক্রমে কিছু চলে আসলেও তা ময়লার ঝুরিতে নিক্ষেপ করা হয় কারণ এই ধরনের ফল দেখলেই আমরা এড়িয়ে যাই। আর এই এড়িয়ে যাওয়া বা না খাওয়ার প্রবণতা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। দাদি-নানিদের কথার সূত্র ধরে আজও আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় যমজ কলা কিংবা যমজ ফল খেতে দ্বিধাবোধ করেন। যমজ ফল না খাওয়ার অন্যতম কারণ, তাঁদের ধারণা যারা যমজ ফল খান তাঁদের যমজ বাচ্চা হয় বা মায়ের গর্ভে বাচ্চার হাতে বা পায়ের আঙ্গুল একত্রে জোড়া লেগে যেতে পারে।
আমাদের দেশে গর্ভবতী মহিলা থেকে কুমারীরা বা কিশোরীরাও এই কথা জানেন। যমজ ফলকে অনেকে এতই শক্তিশালী ভাবেন যে কেউ যদি জীবনে একবার যমজ ফল খেয়ে ফেলেন, তাহলে যমজ বাচ্চা তাঁর ক্ষেত্রে জন্ম দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়ে যায়। এই অলিক কল্পনা বা বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা কারো জানা আছে বলে মনে হয় না।
রূপকথার গল্পের পর পাঠকদের মনে একটা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে "তাহলে কেন বা কিভাবে জমজ (Twin) ফলের জন্ম হয়।" জমজ ফলকে আমরা অপ্রচলিত আকৃতির ফল বা উদ্ভট আকৃতির ফল বলতে পারি। কেননা আপেল, কলা, বেগুন, স্ট্রবেরি ইত্যাদি ফল যখন টুইন হিসেবে জন্ম নেয় তখন দেখতে উদ্ভট লাগে তাই এখানে অপ্রচলিত ও উদ্ভট শব্দ দু'টি ব্যবহার করা হয়েছে।
অধিক তাপমাত্রা ও প্রতিকূল পরিবেশের কারণে পলিনেটরের উপস্থিতি কমে যায় ফলে অপর্যাপ্ত
পরাগায়ন ঘটে ও বিভিন্ন রকম ফলের বীজের যথাযথ বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটে ও পরিপক্ক ফল উৎপাদন ব্যাহত হয়। এছাড়াও ফলের ভ্রুনের যে অংশে বৃদ্ধি ঘটে (primordium) সেখানে পরিবেশগত কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হয় যে কারণে ফলের আশ্চর্যজনক বৃদ্ধি ঘটে। যাকে দেখতে জমজ মনে হয় অর্থাৎ দুটি ফল একসাথে লেগে থাকে।
বিভিন্ন ফল ও সবজির অস্বাবাভিক আকার আমাদের দেশে প্রচুর দেখা যায়। যার কারণ মূলত পরিবেশের উপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে সবজি বা ফলের কোনো অংশ ক্ষতিগ্রস্থ হলে সেই অংশের কোষ বিভাজন হ্রাস পায়। কিন্তু একই সবজি বা ফলের অন্য অংশের কোষ বিভাজন যথাযথ ভাবে চলতে থাকে। যেখানে কোষ বিভাজন কমে যায় সেখানে একই আকৃতির তুলনামূলক ছোট একটি ফলের মত সৃষ্টি হয় যা দেখতে টুইন মনে হয়। যাকে আমরা যমজ ফল বলে থাকি। মুলা বা গাজর একই পদ্ধতিতে যমজ অবস্থার সৃস্টি করে অর্থাৎ আঘাতপ্রাপ্ত স্থানে অধিক পরিমাণে মিউটেশন ঘটে ও ফলের অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটে।
এছাড়াও যমজ জোড়া লাগা ফল সৃষ্টি হওয়ার কারণ হলো একই পুষ্প দণ্ডে জন্ম নেয়া দুটি পৃথক পৃথক স্ত্রী পুষ্প পরাগায়নের পর যাদের ওভারি একত্রে লেগে যায় আস্তে আস্তে। এই একত্রে লাগানো ওভারি দুটি বৃদ্ধি পেতে থাকে যা পরবর্তীতে একটি জট লাগানো যমজ ফল রূপে আত্মপ্রকাশ করে। এই জোড়া লাগা টুইন ফল গুলো সাধারণত একই পুষ্পদণ্ডে জন্মে তাই একই বৃন্তে দুটি ফল জোড়া অবস্থায় থাকে আবার কখনো কখনো দুটি বৃন্তই একত্রে জোড়া লেগে থাকে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য জোড়া লেগে থাকা টুইন ফলের মধ্যে একটি আকারে একটু বড় ও অন্যটি আকারে ছোট হয়। এই ধরনের টুইন (Twin fused fruit) Cucumis sativus L উদ্ভিদে প্রথম আবিস্কার করা হয়।
এছাড়াও বিভিন্ন দেশে ক্রেতা আকর্ষনের জন্য আজকাল ফল ও বিভিন্ন প্রকার সবজিকে জোর পূর্বক আকার আকৃতি পরিবর্তন করে দেয়া হয়। যেমন কুমড়াকে মিকি মাউস আকার দেয়া হচ্ছে। জাপানে তরমুজকে কিউবিক আকার দেয়া হয়।যেখানে অপরিপক্ক অবস্থায় ফলটিকে যে আকৃতি দেয়া হবে ঠিক সেই আকৃতির সাচের ভিতর রেখে প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করা হয়। পরিপক্ক হয়ে যখন সাচের আকার ধারন করে তখন ফল সংগ্রহ করা হয়। তবে ফলের স্বাভাবিক আকৃতি নষ্ট করে কৃত্রিম উপায়ে দেয়া আকার আকৃতিতে গুণগত মানের ক্ষতি না হলেও অনেকেই এই ব্যাপারটাকে নেতিবাচক হিসেবেই দেখে থাকেন। আজকাল এই ধরনের আকৃতির ফল নিয়ে অনেক অসাধু লোক সাধারণ মানুষকে প্রতারনা করে থাকে। যা কখনোই কাম্য নয়।
তবে প্রকৃত সত্য সম্পর্কে বলতে গেলে একথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, যমজ কলা কিংবা যমজ কোনো ফল খাওয়ার কারণে কারো যমজ সন্তান হয় না। জরায়ুতে যমজ সন্তান হওয়ার বিষয়টি নিতান্তই প্রকৃতির খেয়াল।
মহিলাদের ক্ষেত্রে প্রতি মাসের নির্দিষ্ট সময়ে একটি করে পরিপক্ব ডিম্বাণু ডিম্বাশয় থেকে বের হয়ে তা জরায়ুর দিকে ধেয়ে যায়। ডিম্বানুকে এই পথ চলার গতি দেয় ডিম্বাশয় ও জরায়ু-নালির সংকোচন প্রসারণ, যেভাবে পরিপাক নালিতে খাদ্যবস্তু চলাফেরা করে অনেকটা এই নিয়মে। এই ডিম্বানু জরায়ুতে পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকে কাঙ্ক্ষিত শুক্রাণুর জন্য। প্রায় ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ডিম্বানু মারা যায়। এদিকে এই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে কোনো পুরুষের সহযোগিতা পেলে ডিম্বাণুটি শুক্রাণু বেছে নেয়। প্রতিবার সহবাসের মাধ্যমে কম করে ২০ মিলিয়নের বেশি শুক্রাণু বেরিয়ে আসে। এত শুক্রাণুর ভেতর থেকে মাত্র একটি শুক্রাণু ডিম্বাণুর চারদিকের দেয়াল ভেদ করে ডিম্বাণুর সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। মিলিত হতে না পারলে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব শুক্রাণু মরে যায়। এভাবে ডিম্বাণু –শুক্রাণুর মিলিত জাইগোট জরায়ুর দেয়াল গেঁথে গিয়ে সন্তানে পরিণত হওয়ার দীর্ঘ সংগ্রাম শুরু করে। এ তো গেল একটি সন্তান জন্মানোর প্রক্রিয়া।
অন্যদিকে যমজ সন্তান জন্ম হয় দুটি পদ্ধতিতে।
প্রথমত ডাইজাইগোটিক টুইন বা যমজ: একই মাসে একই সঙ্গে দুটি ডিম্বাশয় থেকে দুটি ডিম্বাণু অথবা একই ডিম্বাশয় থেকে দুটি ডিম্বাণু নির্গত হয়। এবং প্রতিটি ডিম্বাণু আলাদা আলাদা একটি করে শুক্রাণুর সঙ্গে মিলিত হয়ে যমজ সন্তান উৎপাদন করে থাকে। এ ক্ষেত্রে দুটি ছেলে অথবা দুটি মেয়ে অথবা একটি ছেলে অথবা একটি মেয়ে হতে পারে। এদের গায়ের রঙ, চোখের রঙ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ভিন্ন হওয়ার পাশাপাশি রক্তের গ্রুপ একই অথবা ভিন্নতর হতে পারে। আর এ কারনেই এদের একে অপর থেকে সহজেই শনাক্ত করা যায়।
দ্বিতীয়ত মনোজাইগোটিক টুইন বা যমজ: এ ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়ের যে কোনো একটি থেকে মাত্র একটি ডিম্বাণু নির্গত হয় ও একটি মাত্র শুক্রাণু দ্বারা নিষিক্ত হয়ে শুধু একটি এককোষী জাইগোট তৈরি হয়। পরে কোষসংখ্যা বৃদ্ধির জটিল প্রক্রিয়া মাইটোসিসের মাধ্যমে সমান দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে, দুটি যমজ সন্তান উৎপন্ন হয়ে থাকে। এভাবে দুই বা ততোধিক যমজ সন্তান হতে পারে। এদের গায়ের রঙ, চোখের রঙ, লিঙ্গ, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এমনকি রক্তের গ্রুপও হুবহু একই হয়ে থাকে। এরা প্রয়োজনে একজন আরেকজনকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারে। এদের বাহ্যিক চেহারার সম্পূর্ণ মিল থাকায় অনেক সময় বাবা মা-ও শনাক্ত করতে পারেন না কে কোনজন।
সুতরাং যমজ সন্তান জন্ম নেওয়ার ব্যাপারে যমজ কলা কিংবা অন্য কোনো যমজ ফলের কোনো ভূমিকা নেই। যমজ ফল যমজ সন্তানের জন্ম দেয়- এ রকম ধারণাকে সঠিক বলে মেনে নেওয়ার সপক্ষে একটিও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নেই।
ছবি: টুইন ফল।